বলতে মানা

​৪০টি কুকুর পাড়া দাঁপিয়ে বেড়াতো একসময়।

হ্যাংলা-চ্যাংড়া, দুবলা-গাবদা, পুঁচকে-ফিঁচকে,

নানান রঙের নানান ঢঙের ৪০টি প্রাণী তারা।

গলায় ডগট্যাগ ছিলো বলে

পাড়ার অন্য কুকুরগুলো বেশ সমীহ করে চলতো।

তাই সময়ে অসময়ে চিৎকার করে করে

নিজের উপস্থিতি জানান দিতো তারা।

পাড়া পাহারায় নিবেদিত ওরা

কখনোই হারেনি প্রলোভনের কাছে,

আর যেহেতু পাকড়েছিলো অনেক চোর-ছ্যাঁচোর

ভেবেছিলো চিরদিন এভাবেই যাবে হয়তো।

না।

একদিন সকালে তাদের ডেকে পাঠালো

জাহান্নামের দারোয়ান।

লাইন দিয়ে সবাইকে দাঁড় করিয়ে

একে একে টেনে ছিঁড়ে ফেললো সবার ডগট্যাগ,

আর বললো– ‘মিশে যাও’।

ব্যস্‌! খেল্‌ খতম!

নিমিষে পাড়ার নামকরা কুকুরের দল

হয়ে উঠলো ‘গলির কুত্তা’।

এখন

উঠতে-বসতে চলতে-ফিরতে

তাদের কপালে জোটে শুধুই লাঞ্ছনা।

চলতে চলতে হয়তো নেহাৎ খেয়ালের বশেই

সবুট লাথি হাঁকায় পাড়ার দারোয়ান,

এমনকি ছিঁচকেরাও।

বেখেয়ালে কখনো সখনো শ্বদন্ত বেরোতে চাইলেও

মুখ চাপা দিয়ে তা আড়াল করতে হয়,

জাহান্নামের নির্দেশ যে!

খুব যখন কষ্ট হয়,

অসহ্য মনে হয় বেঁচে থাকা,

বালিতে মুখ গুঁজে কেঁদে চলে চুপিচুপি।
অনেকদিন ওদের চিৎকার শুনি না আর।

চুপ করে থাকতে থাকতে গলা শুকিয়ে গেছে হয়তো।

কিংবা ভুলেই গেছে কথা বলা।

কুকুর যে! অমান্য করে কিভাবে জাহান্নামের নির্দেশ!

বললেই হলো!

​’চলে যাই’ বললেই

হয় না ক’ যাওয়া।

দুঃখ চিন্তার মতোই

বারবার ফিরে আসবো–

ভাসাবো প্রেমে,

নয়তো অশ্রুস্রোতে।

গল্প । মহারাণীর কবিতা

আজ সকাল থেকেই একটু অন্যরকম হয়ে আছে মহারাণীর মনটা।

সবকিছুই তাঁর কাছে মনে হচ্ছে একেকটি কবিতা। ঐ গাছ একটা কবিতা, ঐ ফুল আরেকটা কবিতা, আকাশ-বাতাস-পাখি থেকে শুরু করে ঐ সান্ত্রী পর্যন্ত সবই আলাদা আলাদা কবিতা মনে হচ্ছে তাঁর কাছে।

এমন কেন হচ্ছে? তাহলে কী মহারাণী কবি হয়ে গেলেন? শিল্প-সাহিত্যে এবার নতুন যুগের সূচণা করবেন তিনি? মানুষের মুখে মুখে ছড়াবে তাঁর কবিতা? শুধু কবিতাই বা কেন, গল্প-উপন্যাসও কি হবে না কিছু সৃষ্টি? অবশ্যই হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর মনে পড়লো, তার আগে সিংহাসন দখলকারী এক রাজা তো কবি হিসেবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন! অবশ্য নিন্দুকেরা বলে, সেসব কবিতা নাকি অন্য কাউকে দিয়ে লেখানো। বংশধরের মতো সেগুলোও কোন এক মহান ব্যক্তির মহানুভবতার প্রকাশ্য রূপ। সে যাক গে, লোকে তো কতো কথাই বলে, সেসব কী আর শুনতে হয়? এই যে আমাদের মহারাণীকে সবাই ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল’ বলে ডাকে, সেটা কী তিনি জানেন না! অবশ্যই জানেন। তাঁর চরেরা নিয়মিতই সেসব খবর শোনায়, কিন্তু তিনি ভ্রুক্ষেপ করেন না। ঐ যে কে বলেছিলো না, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। মহারাণীও সেই একলা চলা দুর্দম দুর্বিনীত মহামানবের অনুসারী। কেউ না থাকুক পাশে, তবু তিনি একাই জয় করবেন সারা বিশ্ব!

এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরে ঢোকে মহারাণীর খাস অমাত্যরা। সংখ্যায় তারা তিন। বিস্তারিত পড়ুন

সময় । নিশিহীন প্রদীপ

বহুদিন হলো হয় না তো দেখা,
আগের মতো হয় না আড্ডা দেয়া,
বৃষ্টি-ছায়ায় হয় না শখের হাঁটা।
সেসব দিনের স্মৃতি বুকে নিয়ে
হাঁটছি আমি অচেনা এই পথে,
চারপাশে আজ শেয়াল-শকুন
ঘুরছে আমার খোঁজে,
জানি না কবে থামবে এ লুকোচুরি।
টিভির স্ক্রিনে দেখবে আমায় তখন,
ভাববে- যদি যেতাম একটু আগে!

এসব পড়ে উতলা যদি হও,
মনটা শুধু ছুটে আসতে চায়
হারিয়ে যাওয়া সেই সে পথের বাঁকে,
হাত বাড়িয়ে ডাকতে আমায় চাও,
জেনো, আমি যে আজ হারিয়ে গেছি পথে,
পথেই খুঁজি পথের দিশা রোজ।

তবু বন্ধু, এলে পরে এদিক দিয়েই যেও,
হয়তো দেখা হবে কোন এক বিকালে,
কিংবা কখনোই নয় আর……

উপহার

এমনিতেই অফিসে ঢুকতে আজ দেরী হয়ে গেছে উৎসবের। বসের ঝাড়ি তো জুটেছেই, উপড়ি আছে কলিগদের বিরক্তি। তার উপর হঠাৎ ফোন এক ছোট বোনের, এক্ষুনি দেখা করা দরকার, কি যেন জরুরী কাজ আছে তার।
প্রথমে ভেবেছে মানা করে দেবে। কিন্তু চিন্তা করে দেখলো, যথেষ্ট বিচক্ষণ আর বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্না মেয়েটা, আর কখনো তাকে এভাবে ডাকেনিও আগে। তার মানে, নিশ্চয়ই খুব জরুরী কিছু হবে। তাই যাওয়াই স্থির করলো উৎসব।
কোনরকমে বস্‌কে ম্যানেজ করে, সবার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দ্রুত পথে বের হয় সে। রাস্তায় নেমেই আবার মেজাজ বিগড়ায়— এই শহরে কী মানুষ থাকে! এত্তো জ্যাম! ১০ মিনিটের রাস্তায় ঘন্টা পরেও পার হওয়া যাবে কিনা সন্দেহ! অতঃপর কি আর করা, গাড়ি-ঘোড়ার চিন্তা ছেড়ে দ্রুতপায়ে হাঁটা শুরু করে ও।
লক্ষ্য অবশ্য দূরে নয়। মিনিট দশেকের মধ্যেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মার্কেটের নীচে উপস্থিত হয়। তারপর ফোনে নিজের অবস্থান জানান দিয়ে এক কোণে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।
একটু পরেই দেখে কাঙ্ক্ষিত জন উপস্থিত। সাথে এক বান্ধবী। হাতে একটা মোবাইল কোম্পানির নাম-লোগো লেখা ব্যাগ। চেহারা দেখে মনে হয় না কোন সমস্যা বা শঙ্কায় আছে মেয়েটা।
কাছে এসেই বলে, হ্যাপী বার্থ ডে ভাইয়া…..
মুখে ধন্যবাদ জানালেও মনে মনে খুব বিরক্তি বোধ করে উৎসব।
“ধ্যাৎ! জরুরী কথার নামে ডেকে বার্থ ডে উইশ! নাঃ, মেয়েটার আক্কেল সম্পর্কে ধারণাটা এবার বদলানোই উচিৎ!”
“কি ভাবছো, ভাইয়া? খাওয়াবে না? পার্টি কবে?”
“ধ্যাৎ! এই বুড়ো বয়সে আবার জন্মদিন! বরং মৃত্যুবার্ষিকী পালনের প্রস্তুতি নে।”
“কি যে বলো না… তুমি না থাকলে কতো বড় ক্ষতি হবে আমাদের, জানো! তোমার মরা চলবে না।”
“হ্যাঁ, চাপাতিওয়ালাদের গিয়ে বোঝাও এটা!”
দু-একটা টুকটাক কথা বলেই হঠাৎ ঘড়ি দেখে মেয়েটা। “ভাইয়া, আমার আবার টিউশনি আছে। আজ যাই। পরে কথা হবে ‘খন।”
“হ্যাঁ, যা। আমারও কাজ জমে আছে অনেক। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে।”
“ও হ্যাঁ, নাও, এটা তোমার জন্য।” হাতের শপিং ব্যাগটা উৎসবের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“এসব আবার কি!”
“মোবাইল সেট। তুমি ভাঙ্গা মোবাইল ব্যবহার করো, আমার ভালো লাগে না। এটা দিয়ে তোমার কাজ চলে যাবে মনে হয়। পরে একটা ভালো দেখে কিনে নিও।”
উৎসবের মুখে কোন কথা সরে না। কি বলবে ভাষা খুঁজে পায় না যেন। ও তো জানে, দিন-রাত টিউশনি করে নিজের থাকা-খাওয়া-পড়ার খরচ জোগাতে কি নিদারুণ কষ্ট করতে হয় মেয়েটাকে। এতো কষ্টের টাকা দিয়ে কিনা আস্ত একটা মোবাইল ফোন কিনে দিলো পাতানো ভাইটাকে!
চারপাশ খুব ঝাপসা লাগছে ওর! যন্ত্রের তো আবেগ থাকে না। তাহলে?